
ফাইল ছবি
দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি স্কয়ার ফুট চামড়া উৎপাদিত হলেও কাঙ্ক্ষিত হারে রপ্তানি হচ্ছে না। বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডের কাছে চামড়া রপ্তানির জন্য যেসব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রয়োজন, তা অধিকাংশ ট্যানারির নেই। বিশেষ করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) এর সনদ না থাকায় বড় বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
চামড়া খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক সনদ না থাকায় চামড়া রপ্তানির দামও অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় হারাতে হচ্ছে—যার পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
রপ্তানির সম্ভাবনা থাকলেও মান নেই
ট্যানারির মালিক ও খাতসংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, চামড়া উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি দিন দিন কমছে। এখন রপ্তানির বড় অংশ চীনে, যারা তুলনামূলকভাবে কম মানের চামড়া কম দামেই কিনে নেয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন,
“আমরা গড়ে ৬০–৭০ শতাংশ চামড়া রপ্তানি করতে পারি। আগে এটা আরও বেশি ছিল। তবে বিগত এক দশক ধরে রপ্তানি কমছে। আন্তর্জাতিক মান না থাকায় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।”
বিশাল উৎপাদন, সীমিত বাজার
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৩০ কোটি স্কয়ার ফুট চামড়া উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে কোরবানির ঈদেই আসে প্রায় অর্ধেক। ২০২৫ সালের কোরবানিতে প্রায় ৯১ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে, যার চামড়া থেকে আসবে ২৯–৩০ কোটি স্কয়ার ফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়া।
এর বড় একটি অংশ রপ্তানি হয় চীনে, বাকি অংশ ব্যবহৃত হয় দেশীয় পণ্য তৈরিতে। তবে চীন ছাড়া ইতালি, স্পেন, ভিয়েতনাম, হংকং, জাপান ও ভারতেও কিছু চামড়া যায়। একসময় ইউরোপ ও আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলো বড় ক্রেতা থাকলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে।
মানহীনতার দায় কার?
২০১৭ সালে সরকারের নির্দেশে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয় সাভারের বিসিক চামড়া শিল্প নগরীতে। উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়াকরণ ও আন্তর্জাতিক মান রক্ষা। তবে এখনো সেই মান অর্জন হয়নি।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) এর সহ-সভাপতি এম এ আউয়াল বলেন,
“সরকার ট্যানারিগুলোকে স্থানান্তরের পরও সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। ফলে আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে রপ্তানির সম্ভাবনাও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।”
শুধু ৫টি ট্যানারির সনদ
বর্তমানে দেশে মাত্র ৫টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে—অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার ও এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ। বাকি ১৪২টির বেশি ট্যানারি এই সনদের বাইরে।
ড. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন,
“বিশ্বের চামড়ার কাঁচামালের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। অথচ বৈশ্বিক রপ্তানির অংশ মাত্র ০.৭ শতাংশ। এটা আমাদের জন্য বড় ব্যর্থতা।”
ইউরোপে চামড়া ২.৮ ডলার, চীনে ১.২
চীন ও ইউরোপের দামের পার্থক্য প্রসঙ্গে তাজিন লেদার করপোরেশনের এমডি আশিকুর রহমান বলেন,
“ইউরোপে চামড়ার দাম প্রতি স্কয়ার ফুট ২.৮ ডলার হলেও চীনে বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৯০ সেন্ট থেকে ১.২০ ডলারে। এতে লোকসান স্পষ্ট।”
বিদেশি চামড়া আমদানির চাপ
দেশে উৎপাদন যথেষ্ট হলেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করতে গিয়ে এখন প্রতি মাসে ১০–১২ লাখ স্কয়ার ফুট চামড়া আমদানি করতে হয়। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের চামড়া আমদানি করতেই হচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকার চামড়া আমদানি করেছে। অর্থাৎ একদিকে রপ্তানি কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি নির্ভরতা।
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাও বড় অন্তরায়
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, সাভার চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১১শ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে আংশিক প্রস্তুতি নিয়েই ট্যানারি স্থানান্তর হলেও আজও পুরোপুরি চালু হয়নি সিইটিপি।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন,
“সাভারের প্রকল্পে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে আজ চামড়া খাত পিছিয়ে আছে। দুর্নীতির অভিযোগে দুদক ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।”
ব্যবসায়ীদের হতাশা
এসেন্সর লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশফিকুর রহমান মাসুদ বলেন,
“আমাদের বড় কোনো আন্তর্জাতিক ক্রেতা নেই। শুধু চীনের কিছু এজেন্ট যা দাম দিচ্ছে, তাতেই চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে করে বাজার ও দাম—দুটোতেই আমরা মার খাচ্ছি।”
চীনা এজেন্টরা এখন দেশের ভেতরে আবাসিক অফিস খুলে সরাসরি আড়ত ও ট্যানারিতে ঢুকে যাচ্ছে। সিন্ডিকেট বাজার তৈরি করে কম দামে চামড়া কিনে নিচ্ছে।
উপসংহার:
চামড়া শিল্পে বাংলাদেশ যেমন উৎপাদনে সক্ষম, তেমনি রপ্তানিতে পিছিয়ে। কারণ, পরিপূর্ণ কমপ্লায়েন্স এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়া। সাভারের শিল্প নগরীতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, এলডব্লিউজি সনদের অভাব, বিদেশি ব্র্যান্ডের চাহিদা না পূরণ হওয়া—সব মিলে এই শিল্প দীর্ঘমেয়াদি সংকটে রয়েছে।
এই সংকট কাটাতে প্রয়োজন সরকার, উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত ও বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ, যা আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মাধ্যমে আবারও বাংলাদেশকে চামড়া রপ্তানিতে নেতৃত্বে নিতে পারে।
ইউ