
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক সভাপতি, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার-এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
আজ বুধবার এক শোক বার্তায় উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, অধ্যাপক যতীন সরকার-এর মৃত্যুতে দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো। উদীচী হারালো অন্যতম অভিভাবককে।
শোক বার্তায় উদীচীর নেতৃবৃন্দ বলেন, ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক যতীন সরকার। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করলেও ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা ছিল তার। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করেন তিনি। আইএ পাসের পর ভর্তি হন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করার পরপরই তিনি প্রথমে গৌরীপুর হাইস্কুলে এবং ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৬০ এর দশকে ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনিসহ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব একত্রিত হয়ে ময়মনসিংহে উদীচীর যাত্রা শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বেই পুরো জেলায় উদীচীর কার্যক্রম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮০-এর দশক থেকেই অধ্যাপক যতীন সরকার উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০৩ সালে উদীচীর সভাপতি নির্বাচিত হন। টানা দুই মেয়াদে দাযিত্ব পালনের পর ২০০৮ সালে সভাপতি পদ থেকে বিদায় নেন তিনি। তবে, সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়ার পরও আমৃত্যু তিনি উদীচীর আদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। যেকোন সংকটে বা সংগ্রামে দেশ ও বিদেশে উদীচীর হাজারো শিল্পী-কর্মীর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যাপক যতীন সরকার।
অধ্যাপক যতীন সরকার আজীবন সামাজিক নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত দেশ গঠনে সচেষ্ট থেকেছেন। তিনি মনে করতেন, সমাজ থেকে দুর্নীতি, অবিচার, বৈষম্য ইত্যাদি দূর না হওয়া পর্যন্ত দারিদ্র্য কমিয়ে আনা যাবে না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করতেন অধ্যাপক যতীন সরকার।
সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থকার হিসেবে জাতির মনন গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছেন অধ্যাপক যতীন সরকার। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে পাকিস্তানের জন্ম মৃতু-দর্শন, বাংলাদেশী কবি গান, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, বাঙ্গালী সমাজতন্ত্র ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, মানব স্বপ্ন এবং সমাজ বিপ্লব, আমাদের সাংস্কৃতিক দিগ-দিগন্ত ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এছাড়া, বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন অধ্যাপক যতীন সরকার।
দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন অধ্যাপক যতীন সরকার। গত কয়েক মাসের মধ্যে দু'বার ঢাকার হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। যেতে হয়েছে আইসিউইতেও। শেষ দিকে কিডনি, ফুসফুসসহ বিভিন্ন অঙ্গে জটিলতা দেখা দেয় তাঁর। কিছুটা সুস্থ হয়ে ময়মনসিংহে ফেরত গেলেও চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভকামনা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ আগস্ট দুপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অধ্যাপক যতীন সরকার। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক সভাপতি, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার-এর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার ও শোকসন্তপ্ত স্বজনদের সমবেদনা জানিয়েছেন উদীচীর নেতৃবৃন্দ।
টিএইচ