
আদিবাসী সংস্কার কমিশন গঠনের জোর দাবি করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সেই সাথে জাতীয় চার নীতির বাস্তবায়নের দাবি উত্থাপন করা হয় ।
আজ রোববার (১০ আগস্ট) রাজধানীর সিরডাপে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি, বন ও মানবাধিকার সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয় শীর্ষক সেমিনারে এ দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।
এএলআরডি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও অন্যান্য ১৫টি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সেমিনারের পৃথক দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষে উজ্জ্বল আজিম এবং এএলআরডি-র পক্ষে রফিক আহমেদ সিরাজী। এতে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার, বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলাম লেখক এবং প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী প্রধান পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ। সূচনা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ।
সেমিনারে সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমাদের আদিবাসী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন জরুরী। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলেও এই কমিশন গঠন করে আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব।
প্রবন্ধ উপস্থাপক উজ্জ্বল আজিম বলেন, বাংলাদেশের সমতলভূমিতে বসবাসকারী আদিবাসীরা এখনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকায় তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নানাভাবে। ঐতিহ্যগতভাবে বসবাসরত ভূমি জোরপূর্বক দখল, দলিল জালিয়াতি ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ঘর উচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এছাড়া স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আদিবাসীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, ফলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। এই প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
অন্য আরেক প্রবন্ধ উপস্থাপক রফিক আহমেদ সিরাজী বলেন, জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের মানবাধিকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নারীর অধিকার সুরক্ষা আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য হ্রাস, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভূমি অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষায় বিষয়গুলো প্রথমদিকে যতটা গুরুত্ব পেয়েছিল, এখন তা আর অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেসব সংস্কারের সুপারিশ কেবল কাগজে ফাইলবন্দি হয়ে আছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রকৃত অর্থে যেসব সংস্কারের প্রয়োজন ছিল সেসব সংস্কারের জায়গাগুলো এখনো অনুল্লেখিত রয়ে গেছে।
খুশী কবির বলেন, গত বছরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্য নিরসন এবং সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন তৈরি হয়। সেখানে অনেকের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের সকলের মতামত হয়তো সেখানে প্রতিফলিত হয়নি। যে আশা আকাঙ্খা নিয়ে আমরা আমাদের দেশ স্বাধীন করেছি, সেই জাতীয় চার নীতির বাস্তবায়ন যাতে হয়- সেই দাবি তুলছি।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আমরা যে সংকট দেখতে পেয়েছি তা হল আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকট। আজকে আমরা সেই অস্তিত্বের সংকট দেখতে পাই সমতলের আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভূমি বেদখলের মাধ্যমে। ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার সনদ প্রণয়ন করা হয়, সেখানে ১১টি দেশ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
আইনুন নাহার বলেন, বাংলাদেশে আধিপত্যশীল গোষ্ঠীর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। যেখানে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে ভুল তথ্য তৈরি ও পরিবেশনের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সার্বিক সুরক্ষা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, সেখানে বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভ‚মিকা রাখবে-এই বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ।
সোহরাব হাসান বলেন, এই রাষ্ট্র পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু এই রাষ্ট্র সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কমিশনের কোনো মিটিং হয়নি। ২২ হাজার আবেদন রয়েছে। শান্তিচুক্তির মুল কথা ছিলো তাদের স্বতন্ত্রতাকে গুরুত্ব দেয়া। আমরা খুবই আশাহত হই, ব্যথিত হই, যখন আমরা দেখি তরুণ প্রজন্ম ৭১ এর সাথে ২৪ এর সমরূপিতা দেখে।
পল্লব চাকমা বলেন, এখন আমরা আসলে বিভিন্ন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছি। গত বছরে ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম এবারে আদিবাসীদের জীবনে কিছুটা হলেও শান্তি আসবে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে রাঙামাটিতে প্রকাশ্য দিবালোকে অনিক চাকমাকে কুপিয়ে হত্যাকান্ড, আঞ্চলিক পরিষদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এটা খুব আতঙ্কের বিষয়। আমরা দেখেছি আদিবাসীদের সুরক্ষায় কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনী এগিয়ে আসেনি। এই সরকার পাহড়ের মানবাধিকার নিয়ে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, গত ৭ আগস্ট থাইল্যান্ড সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার আইন পাস করেছে। আমরা আশা করছি এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করবে।
শামসুল হুদা বলেন, বাংলাদেশে অন্য দিবস যে মর্যাদায় পালিত হয়, সেই মর্যাদায় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করতে হবে।
টিএইচ