
ইতিহাস কখনো সরল রেখায় আঁকা হয় না। সে বাঁকা পথে, পাহাড়-উপত্যকায়, রক্তের ছোপ দিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টও এমনই এক বাঁকা দিন।
বিকেলটি সূর্যের মতো আলোকিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তে তা পরিণত হয় রক্তাক্ত অরুণোদয়ের ছায়ায়। লক্ষ্য ছিল জাতীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করা, কিন্তু গ্রেনেডের টুকরো সাধারণ মানুষের শরীরে বিধল, মা–সন্তানের কোল ছিঁড়ে নিল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ রক্তে ভাসল—মাঠ যেন রক্তের ক্যানভাস।
একুশ বছর কেটে গেছে। সময় ক্ষত শুকিয়ে দেয়, কিন্তু এই ক্ষত যেন আরও গভীর হয়। আইভি রহমানের নাম উচ্চারণ করলে আজও কানে বাজে ভাঙা শরীরের হাহাকার। আহতরা যেন জীবনের বোঝা বহন করছেন—যেমন কেউ শূন্য আকাশ থেকে নেমে আসা ধূলোর ভার। রাজনীতির মঞ্চে তাদের ব্যথা চাপা পড়ে যায় মাইকের গর্জনে, প্রতিশোধের ভাষণে।
এ গল্প শুধু শোকের নয়, প্রশ্নেরও। আদালতের রায়ে অপরাধীদের সাজা হয়েছে, তবে ন্যায়বিচারের গায়ে লেগে আছে অপূর্ণতার ধুলো। বিদেশে পালিয়ে বেড়ানো আসামিরা যেন রাষ্ট্রের হাত এড়িয়ে হাঁটে ভিন্ন আকাশে। ইতিহাসের আদালত নীরব নয়; সে ফিসফিস করে প্রশ্ন তোলে—রাষ্ট্র কি যথেষ্ট করেছে, নাকি কেবল স্মরণসভায় মোমবাতি জ্বালিয়েই দায় সেরেছে?
নতুন প্রজন্মের চোখে রাজনীতি যেনো এক বড় অরণ্য, যেখানে তারা শিখেছে বইয়ের পাতায় ইতিহাস, বক্তৃতার শব্দে শোক, ভিডিও ফুটেজে রক্ত। কিন্তু তাদের প্রশ্ন আরও গভীর—রাজনীতি কি মানুষের সেবা, নাকি প্রতিপক্ষকে মুছে ফেলার খেলা? একুশে আগস্ট যেন সেই প্রশ্নের রক্তাক্ত উত্তর, যেখানে গ্রেনেডের টুকরো হয়ে উঠেছিল রাজনীতির অভিধান, আর গণতন্ত্রের পাতায় লেখা হয়েছিল রক্তের ব্যাকরণ।
২১ আগস্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতি যখন মানবিকতার পথ ছেড়ে প্রতিহিংসার পথে হাঁটে, তখন সভা-সমাবেশ রূপ নেয় হত্যার মাঠে। বুলেট, বোমা, গ্রেনেড—এগুলো গণতন্ত্রের ভাষা নয়; এগুলো অমানবিকতার অক্ষর। একুশ বছর পরও দেখা যায়, গণতন্ত্রের শরীরে গ্রেনেডের ক্ষতচিহ্ন শুকায়নি, বরং নতুন বিভাজনের সাথে আবারও রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।
প্রতি আগস্টে ফুলের তোড়া, কালো ব্যাজ, বক্তৃতা—সবই যেনো নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা। কিন্তু বছরের বাকি সময়ে আমরা আবারও প্রতিহিংসার চাকা ঘুরাই, আবার ইতিহাসের ক্ষতচিহ্নে নতুন আঁচড় কাটি। এ কি স্মৃতির প্রতি সুবিচার, নাকি ইতিহাসের সাথে নির্মম পরিহাস?
নিহতরা আসলে সতর্কবার্তা। তারা চোখে আঙুল দিয়ে বলে—সহিংস রাজনীতি আত্মঘাতী। তাদের রক্তে লেখা আছে: গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে ভিন্নমতকে হত্যা নয়, বরং সহনশীলতার মাটিতে আশ্রয় দিতে হবে। ঘৃণা ও হত্যা করার প্রবণতা যেনো বিষাক্ত ছায়া, যা সমাজ ও ইতিহাসকে ঢেকে দেয়।
আজকের দিনে আমাদের দায় শুধু স্মরণ করা নয়; দায় হলো নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়া। এমন সংস্কৃতি যেখানে প্রতিপক্ষ শত্রু নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী; যেখানে রাজনীতি হবে সংলাপের, সন্ত্রাসের নয়। অন্যথায় একুশ আগস্ট কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে, শিক্ষা হবে না। শিক্ষা না হলে ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হবে—ভিন্ন নামে, ভিন্ন রঙে, ভিন্ন রক্তে।
গ্রেনেডের টুকরো আজও রাজনীতির অভিধানে অক্ষর রূপে টিকে আছে। প্রতিটি শোকসভা, প্রতিটি স্মরণসভা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি যদি মানবিকতার পথে না চলে, ইতিহাসের পাতা হয়ে ওঠে রক্তের গ্রন্থ।
একুশ বছর পরও আমাদের দায় শুধুই স্মরণ করা নয়; সতর্কবার্তা মেনে চলা। ঘৃণার শক্তিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে দমন না করলে আগামী প্রজন্মও একই অন্ধকারে পদার্পণ করবে। একুশ আগস্টের রক্ত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বলে—সহিংসতা কখনো সমাধান নয়, বরং জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
আজকের প্রজন্মকে ইতিহাস বলছে: “স্মরণ কর, শিখ, এবং সহনশীলতার মাটিতে রাজনীতি গড়।” একুশ আগস্ট শুধুই শোক নয়, এটি শিক্ষার রক্তচিহ্ন—একটি গল্প, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানবতা রাখতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল - [email protected]
টিএইচ