
বম জাতিগোষ্ঠির ৩ জন নাগরিকের কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং সকল নিরাপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিতে- বিশিষ্ট ১৫৫ নাগরিক ৫ দাবি জানিয়েছেন।
আজ শুক্রবার এক বিবৃতিতে এই দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট ১৫৫ নাগরিক।
দাবিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম কারাগারে লাল থ্লেং কিম বম, লালসাংময় বম ও ভান লাল রুয়াল বমের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের জবাবদিহিতা ও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনা।
অবিলম্বে নিরপরাধ সকল বম নাগরিকের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে ও ক্ষতিগ্রস্তদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষতিপুরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা, হাটবাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, জুম চাষ ও ব্যবসায়িক কাজের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা।
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সাথে কেএনএফসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শনাক্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কেএনএফ ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে জাতিগত নিধন অভিযান চিরতরে বন্ধ করা।
বম জাতিগোষ্ঠীকে ‘কালেক্টিভ পানিশমেন্ট’ প্রদানের কৌশল প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বিচারে কারাবন্দী আদিবাসী বম বাসিন্দাদের মুক্তির পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলের সকল আদিবাসীর সমান অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, অবিলম্বে উক্ত দাবির প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একের পর এক পাহাড়ি আদিবাসীদের উপর সংগঠিত অপ্রীতিকর ঘটনায় রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও নীরবতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সন্ত্রাস দমনে’র নামে বান্দরবানে নির্বিচারে সাধারণ আদিবাসীদের ওপর চলমান নিপীড়ন ও বিশেষ করে বম জাতিগোষ্ঠীর নারী ও শিশুসহ সাধারণ নাগরিকদের বিনা বিচারে আটক ও বছরের পর বছর কারাবন্দি রাখার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে চলতি বছরের গত ১৭ জুলাই বম জতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভান লাল রুয়াল বম (৩৫) এবং এর আগে একই কারাগারে গত ৩১ মে লাল সাংময় বম (৫৫) ও গত ১৫ মে লাল থ্লেং কিম বমের (২৯) কারা হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের পরপর এই ৩টি কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং সকল নিরাপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিতে- আমরা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নাগরিক এই বিবৃতি পেশ করছি।
গত ১৫ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আদিবাসী তরুণ লাল থ্লেং কিম বম (২৯) বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) তথ্যানুযায়ী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই লাল থ্লেং কিমের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। পরিবারের অভিযোগ, কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ( কেএনএফ) সদস্য সন্দেহে লাল থ্লেং কিমকে ব্যাংক ডাকাতিসহ একাধিক মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাবন্দী রাখা হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
গত ৩১ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ক্যান্সার আক্রান্ত লাল সাংময় বম (৫৫) প্রাণ হারানোর শেষ মুহূর্তে জামিন পেয়েছিলেন। ২৫ জুন ২০২৩ এ লাল সাংময় বম, রুমানা পাড়ার কারবারী কাপ ঙির বম ও লাল পেক সাং এই ৩ জনকে নিকটবর্তী সুনসং পাড়ার আর্মি ক্যাম্পে ডাকা হয়। সপ্তাহ ২/৩ দিন ক্যাম্পের ভারি কাজের জন্য প্রায়ই এভাবে ডেকে পাঠানো হয়। এরপর লাল সাংময় বম, কাপ ঙির বমকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হলেও অন্যজন লাল পেক সাং এর কোনো খোঁজ মেলেনি।
সাংময়ের পরিবারের অভিযোগ, মিথ্যে মামলায় ২ বছর ধরে বিনা বিচারে কারাভোগ করেন ক্যান্সার আক্রান্ত এই ব্যক্তি। তার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হলে প্রায় দুই মাস চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। লাল থ্লেং কিমের মৃত্যুর সময়েই কারাসূত্রে জানা যায় লাল সাংময় মৃত্যুশয্যায় আছেন। সাংময়ের শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, দায় এড়ানোর লক্ষ্যে গত ২৯ মে তড়িঘড়ি করে তাকে জামিন দেয়া হয়। কারাগারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৩১ মে চমেক থেকে ছাড়া পেয়ে সেদিনই নিজ গ্রামে ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন লালসাংময় বম।
গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ভান লাল রুয়াল বম (৩৫) বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। চমেক ও চট্টগ্রাম কারাগারের তথ্যমতে, লাল থ্লেং কিমের মতোই হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ভান লাল রুয়াল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। কারা কর্তৃপক্ষ আরও জানান, ১৬ জুলাই রাত ১২টার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারাগারেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরিস্থিতি খারাপ দেখলে রাত ১টার পর তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পরপর এই ৩টি মৃত্যুর ঘটনা আমাদেরকে স্পষ্ট করে যে রাষ্ট্রের এই নাগরিকরা কারাবন্দী অবস্থায় সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই পরিবারগুলোর অভিযোগ তারা কেউই কেএনএফ সংশ্লিষ্ট বা অপরাধী ছিলেন না। এদের বিরুদ্ধে যেসকল অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এর ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো চার্জশিট দেয়নি পুলিশ। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন অপরাধীরও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
উল্লেখ্য ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল যৌথ বাহিনীর গণগ্রেপ্তারের শিকার শিউলি বম চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী আছেন। বম জাতিগোষ্ঠীর এই নারী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বান্দরবানের নিম্ন আদালতে তিনি জামিন পাননি। সবশেষ গত ২৮ জুলাই, উচ্চ আদালতে শিউলিসহ ১১ জন নারীর জামিন আবেদনের শুনানি হলেও জামিন মেলেনি। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে ৪ জন নিরপরাধ নারীর জামিন মঞ্জুর হলেও, পরবর্তীতে সরকার পক্ষের বিরোধীতায় তা আটকে যায়। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই শুধুমাত্র সন্দেহবশত অপরাধী হিসেবে বছরের পর বছর রাষ্ট্রের নাগরিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না। কারা কর্তৃপক্ষ ও বম জাতিগোষ্ঠীর তথ্যমতে, একাধিক নারী-পুরুষ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরপরাধ নারী ও এমনকি মায়ের সাথে শিশুদেরকেও কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। যা অত্যন্ত অমানবিক, হৃদয়বিদারক ও জাতি হিসেবে লজ্জার!
২০২৪ সালের ২ এপিল ও ৩ এপ্রিল, বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কেএনএফ- এর দুর্বৃত্ত কর্তৃক ব্যাংক ডাকাতির জের ধরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘ যৌথ অভিযানে’র নামে বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু হয়। উল্লেখ্য ২০২২ ও ২০২৩ সাল থেকেই নির্বিচারে আটক ও হয়রানির তৎপরতা শুরু করে সেনাবাহিনী। ২০২৪ সালের ব্যংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হয়রানি চূড়ান্ত রূপ নেয়, যা জাতিগত নিধনের শামিল। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে ধরপাকড়, নির্যাতন, গুমের অভিযোগ ও পরিবারের সাথে শিশুদেরকেও অভুক্ত রাখাসহ একাধিক মিথ্যা মামলার শিকার হন নিরাপরাধ নারী, শিশু, শিক্ষার্থী ও বয়োজ্যেষ্ঠরাও। অবশেষে কারাবন্দী অবস্থায় ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে’র শিকার হলেন লাল থ্লেং কিম বম, লালসাংময় বম ও ভান লাল রুয়াল বম।
আমরা মনে করি, কতিপয় ‘কেএনএফ সদস্যদের কর্মকাণ্ড ও অপরাধ দমনে’ র নামে নির্বিচারে গ্রামবাসীকে আটক ও একাধিক মিথ্যা মামলায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা ও নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি। বাঙালি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র এসকল মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। আমরা বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে পরপর এই ৩টি মৃত্যুর চিকিৎসায় অবহেলা ও মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি, নিরপরাধ সকল বম নারী, শিক্ষার্থী, জুমচাষী ও পেশাজীবীদের মুক্তি চাই।
টিএইচ