
বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় গত কয়েক বছর ধরে মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে ছেলেদের চেয়ে ভালো ফল করছে।
পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তি— উভয় সূচকেই ছাত্রীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে চলেছে। যা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই প্রবণতা নারীশিক্ষার অগ্রগতি এবং সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ধারাবাহিক সাফল্যের চিত্র
২০২৪: পাসের হার ও জিপিএ, দুদিকেই এগিয়ে মেয়েরা
গত বছর (২০২৪ সাল) মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে ছিলেন।
১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় বসেছিলেন ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫১৭ শিক্ষার্থী। দেশের তিন হাজার ৭৯৯ কেন্দ্রে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু হয়। ১২ মার্চ শেষ হয় লিখিত পরীক্ষা।
পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০৩ জন, ছাত্র নয় লাখ ৮৮ হাজার ৭৯৪ জন। তাদের মধ্যে আট লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ জন ছাত্রী ও আট লাখ ছয় হাজার ৫৫৩ জন ছাত্র পাস করেছিলেন।
এই হিসাবে ছাত্রীদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন ছাত্রী এবং ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন ছাত্র ছিলেন। এবার ছাত্রদের চেয়ে ১৫ হাজার ৪২৩ জন বেশি ছাত্রী পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পান।
২০২৩: সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে মেয়েরা
২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিলেন মেয়েরা। পাসের হার এবং ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়েও ছাত্রদের পেছনে ফেলেন তারা।
পরীক্ষার ফলাফলের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর পরীক্ষায় মোট ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১০ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৭ জন এবং ছাত্র ১০ লাখ ৯ হাজার ৮০৩ জন। মোট পাস করেন ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। এর মধ্যে ছাত্রী আট লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৬ জন এবং ছাত্র সাত লাখ ৯৬ হাজার ৪০৪ জন। অর্থাৎ ৪৮ হাজার ৩৩২ জন ছাত্রী বেশি পাস করেন।
মোট জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ৯৮ হাজার ৬১৪, আর জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ৮৪ হাজার ৯৬৪। অর্থাৎ ছাত্রদের চেয়ে ১৩ হাজার ৬৫০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পান।
২০২২: এবারও পাসের হার ও জিপিএ, এগিয়ে মেয়েরা
করোনা ও বন্যার কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখের বেশি। তিন হাজার ৭৯০টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল প্রায় ১৬ লাখ।
নয়টি সাধারণ বোর্ডে ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ, মাদ্রাসা বোর্ডে ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেন।
ওইবারও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে ছিলেন মেয়েরা। ছাত্রদের পাসের হার যেখানে ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ, সেখানে ছাত্রীদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ পাস করেন। জিপিএ-৫ পান দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী এক লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন ও মেয়ে শিক্ষার্থী এক লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন।
২০২১: জিপিএ-৫ বেশি পান মেয়ে শিক্ষার্থীরা
২০২১ সালের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষায় ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ছিলেন ১১ লাখ ৪২ হাজার ৩৯৪ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৩০১ জন। পাস করেছিলেন ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ছিলেন ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৮ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৮ জন।
ওই বছর এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পান। তাদের মধ্যে ৭৯ হাজার ৭৬২ জন ছেলে শিক্ষার্থী এবং এক লাখ তিন হাজার ৫৭৮ জন মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন।
করোনাভাইরাস অতিমারীর মধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ছিল সর্বোচ্চ।
২০২০: এবারও এগিয়ে মেয়েরা
২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সম্মিলিত পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮৭। মোট জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী।
পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মোট ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন শিক্ষার্থী পাস করেছিলেন।
সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৮৫ দশমিক ২২ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৮৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৭৯ দশমিক ৭০ শতাংশ, সিলেট বোর্ডে ৭৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে ছিল ৮০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ছিল ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
ওই বছর ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৮১ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ছিল ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
সাফল্যের পেছনের কারণ
শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মেয়েদের এ ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো-
অধ্যবসায় ও মনোযোগ: সাধারণত মেয়েরা পড়াশোনায় ছেলেদের চেয়ে বেশি মনোযোগী ও অধ্যবসায়ী হয়। তারা নিয়মিত পড়াশোনায় বেশি সময় ব্যয় করে।
পারিবারিক সহায়তা ও সচেতনতা: নারীশিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পরিবারগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধ কর্মসূচি এবং মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির মতো সরকারি উদ্যোগগুলো মেয়েদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেয়েদের পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
লক্ষ্য নির্ধারণ: মেয়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পড়াশোনা করে।
২০০১-২০১৯ সাল পর্যন্ত সার্বিক চিত্র
২০০১: মোট পরীক্ষার্থী ছিল সাত লাখ ৮৬ হাজার ২২০ জন। পাসের হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৭৬ জন শিক্ষার্থী। এ বছর প্রতি এক লাখে ১০ জন শিক্ষার্থী অর্জন করে সর্বোচ্চ পয়েন্ট জিপিএ-৫। অর্থাৎ মোট পরীক্ষার্থীর .০০৯৬৬৬৫% জিপিএ-৫ পান।
২০০২: মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ৫ হাজার ৯৩৭ জন। ৪০.৬৬ শতাংশ ছিল পাসের হার। জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৩২৭ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর .০৩ শতাংশ।
২০০৩: মোট পরীক্ষার্থী নয় লাখ ২১ হাজার ২৪ জন। পাসের হার ৩৫.৯১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩৮৯ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর .১৫ শতাংশ।
২০০৪: চতুর্থ বিষয়সহ নম্বর বণ্টন করা হয়। যে কারণে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফেই বেড়ে যায় প্রায় আট গুণ। ওই বছর পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৭ জন। পাস করেছিল ৪৮.০৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ অর্জন করেছিল আট হাজার ৫৯৭ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ১.১ শতাংশ।
২০০৫: মোট পরীক্ষার্থী সাত লাখ ৫১ হাজার ৪২১ জন। পাসের হার ৫২.৫৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ৬৩১ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ১.৬ শতাংশ।
২০০৬: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখ ৮৪ হাজার ৮১৫ জন। পাসের হার ৫৯.৪৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৪ হাজার ৩৮৪ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩.১২ শতাংশ।
২০০৭: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখ ৯২ হাজার ১৬৫ জন। পাসের হার ৫৭.৩৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৫ হাজার ৭৩২ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩.২৪ শতাংশ।
২০০৮: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখ ৪৩ হাজার ৬০৯ জন। পাসের হার ৭০.৮১ শতাংশ। জিপিএ-৫ অর্জন করেন ৪১ হাজার ৯১৭ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫.৬ শতাংশ।
২০০৯: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখ ৯৭ হাজার ৮৯১ জন। পাসের হার ৬৭.৪১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫.৭৫ শতাংশ।
২০১০: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নয় লাখ ১২ হাজার ৫৭৭ জন। পাসের হার ৭৮.৯১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৬২ হাজার ১৩৪ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৬.৮ শতাংশ।
২০১১: মোট পরীক্ষার্থী নয় লাখ ৮৬ হাজার ৬৫০ জন। পাসের হার ৮২.১৬ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৬২ হাজার ২৮৮ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৬.৪ শতাংশ।
২০১২: পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৪ জনে। পাসের হার ৮৬.৩২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৬৫ হাজার ২৫২ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৬.২৩ শতাংশ।
২০১৩: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৩৪ জন। পাসের হার ৮৯.০৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান ৯১ হাজার ২২৬ জন। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৭ শতাংশ।
২০১৪: মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৭২৭ জন। পাসের হার ৯১.৩৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। দেশে গ্রেডিং পদ্ধতিতে নম্বর দেওয়ার প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৪ সালেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করেন। যা মোট পরীক্ষার্থীর প্রায় ১০ শতাংশ।
এছাড়া ২০১৫ সালে জিপিএ-৫ পান এক লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন, ২০১৬ সালে জিপিএ-৫ পান এক লাখ নয় হাজার ৭৬১ জন, ২০১৭ সালে জিপিএ-৫ পান এক লাখ চার হাজার ৭৬১ জন, ২০১৮ সালে জিপিএ-৫ পান এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন।
২০১৯ সালে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৪ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পান। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৪.৯৬ শতাংশ। ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী। যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫ শতাংশ।
টিএইচ