ঢাকা,

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫


কপ-৩০ সামনে রেখে জলবায়ু সনদে যুবসমাজের ২৬ দাবি

তারেক হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত হয়েছে: ২৩:১৬, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কপ-৩০ সামনে রেখে জলবায়ু সনদে যুবসমাজের ২৬ দাবি

 ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিতব্য কপ-৩০ সম্মেলনে বাংলাদেশের তরুণদের কণ্ঠস্বর জোরালোভাবে তুলে ধরতে ২৬ দফা দাবি-সংবলিত একটি জলবায়ু সনদ প্রকাশ করেছে দেশের শতাধিক তরুণ জলবায়ুকর্মী। ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে পর্দা নামলো ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ’এর চতুর্থ আসর।

আজ সোমবার রাজধানীর এক হোটেলে ব্রাইটার্স এবং একশনএইড বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী জলবায়ু সম্মেলন ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ ২০২৫’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে এই সনদ প্রকাশ করা হয়।
জলবায়ু ন্যায়বিচার, জেন্ডার সমতা, পরিবেশ সুরক্ষা, নীতিনির্ধারণে যুবদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজন - এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সনদে স্থান পেয়েছে। 
‘ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের জন্য যুবসমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে গত ৬ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তরুণ প্রতিনিধি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক ও উন্নয়ন সহযোগীরা একত্রিত হয়ে জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য তরুণদের দাবিগুলো তুলে ধরেন।

সম্মেলনের সমাপনী দিনে জলবায়ু ন্যায়বিচার ও ন্যায্য রূপান্তর নিয়ে তিনটি পৃথক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, গবেষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন।
চমকপ্রদ পুতুলনাচ পরিবেশনে জলবায়ু ন্যায্যতার বার্তা দিয়ে শুরু হয় সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠান। 

“সংলাপ থেকে আন্দোলন: ইয়ুথ কপ ২০২৫-এর সমাপ্তি” শীর্ষক সেশনটি সঞ্চালনা করেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। এসময় কপ-৩০ সামনে রেখে জলবায়ু নীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমেরিটাস ড. আইনুন নিশাত জলবায়ু ইস্যুতে বৈশ্বিক নেতাদের দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতার সমালোচনা করে বলেন, “জলবায়ু আলোচনায় ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে প্রায়ই এটি প্রতারণার মতো মনে হয়। আমাদের বড় সমস্যা হলো দুর্বল আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং জবাবদিহিতার অভাব।” 
তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিসরে ভাবতে হবে, কিন্তু কাজ করতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে।”

অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির রাজনৈতিক দলগুলোর জলবায়ু এজেন্ডা, ইশতেহার এবং এ বিষয়ে কাজের জন্য আলাদা লোকবল নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “এ বিষয়টি আশা জাগায় যে, বাংলাদেশের ইতিহাস তরুণ নেতৃত্বকে ধারণ করে। আমি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই তারা যেন তরুণদের কণ্ঠস্বরকে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করে।”

বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুর হাইকমিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিচেল লি বাংলাদেশের সঙ্গে জলবায়ু সহনশীলতা বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, “সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ আর বাংলাদেশের ১৭ কোটি, কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো এক। জলবায়ু সহনশীলতায় আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা বাংলাদেশের সাথে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দলের টিম লিডার এডউইন কোয়েককোয়েক বলেন, “ইউরোপীয় গ্রিন ডিলের মতো উদ্যোগগুলো সম্ভব হয়েছে তরুণদের কারণে, যারা সরকারকে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিতে বাধ্য করেছে। কপ ৩০-এর আগে আমরা সব দেশকে উচ্চাভিলাষী জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) নিয়ে আসার আহ্বান জানাই, যাতে ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।”

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “শহর পর্যায়ে আমরা ইতিমধ্যেই কমিউনিটি ও তরুণদের সঙ্গে কাজ করছি। ডিএনসিসি-র ওয়ার্ডভিত্তিক অ্যাকশন প্ল্যানগুলোতে আমরা জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং নিশ্চিত করছি।”

ন্যাশনাল সিটিজেনস’ পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম সাইফ মুস্তাফিজ বলেন, “এখনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই মেনে নিতে পারেন না যে ৩০ বছরের নিচের কেউ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মতামত দিতে পারে। যদি বাংলাদেশ এগোতে চায় তাহলে এই মানসিকতা বদলাতে হবে।”

ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম)-এর যুগ্ম সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম জাতীয় বাজেটে জলবায়ু খাতে বরাদ্দ অন্তত ৩% করার দাবি জানান। একইসাথে তিনি তরুণদের জলবায়ু আন্দোলনকে টোকেন হিসেবে না দেখে সরাসরি নীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সচেতনতা তৈরি। সচেতনতা ছাড়া কোনো জলবায়ু নীতি সফল হবে না। তাই আমাদের শুরু করতে হবে সেখান থেকেই - সারা দেশে জলবায়ু সচেতনতা বাড়িয়ে।”

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “আমরা কীভাবে নতুন বাংলাদেশ গড়ব? আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শুধু কথায় নয়, প্রতিশ্রুতি হতে হবে সৎ। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকতে হবে—যা বলি তা বাস্তবে করতে হবে।”

ইয়ুথ কপ- ২০২৫ এ অংশ নেওয়া তরুণ জলবায়ুকর্মী ফারিহা অমি বৈশ্বিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা প্রমাণ করেছি যে যুবকরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুযোগ পেলেই অবদান রাখতে পারে। আমরা চাই এই ইয়ুথ কপের মাধ্যমে এই প্রচলিত ন্যারেটিভটাকে ভাঙতে।”
তরুণ প্রতিনিধিরা তাঁদের প্রণীত ‘ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের জন্য দাবি-সনদ’টি নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞদের সামনে উপস্থাপন করেন। প্রশ্নোত্তর ও মতবিনিময়ের পর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ ২০২৫-এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

এর আগে একশনএইড বাংলাদেশ-এর ইয়ুথ অ্যান্ড জাস্ট সোসাইটির লিড নাজমুল আহসানের সঞ্চালনায় ‘ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’ বিষয়ক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় জেন্ডার সমতা, সামাজিক ন্যায্যতা ও জলবায়ু অর্থায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা। এতে অংশগ্রহণ করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, গবেষক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকেরা। 

এরপর ‘ক্লাইমেট পলিসি নেগোসিয়েশন ফেলোশিপ’-এর আওতায় একটি মক ক্লাইমেট নেগোসিয়েশন সেশন পরিচালনা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাসটিস বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এম হাফিজুল ইসলাম খান। এরপর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মনজুর আল মতিনের সঞ্চালনায় ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ‘রাজনৈতিক ইশতেহারে যুবসমাজের দাবির প্রতিফলন’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
সমাপনী সম্মেলনের পূর্ববর্তী কার্যক্রম

সম্মেলনের প্রথম দিনে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) বিশেষ মতামতের ওপর একটি উচ্চপর্যায়ের ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিনে জলবায়ু-জনিত অভিবাসন, জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি), উপকূলীয় চ্যালেঞ্জ ও জলবায়ু অর্থায়ন নীতিতে যুবসমাজের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর একটি ইন্টারেক্টিভ সেশন ও গোলটেবিল আলোচনায় যুব জলবায়ুকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা সম্মিলিতভাবে কপ-৩০-এর জন্য বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থান বা ‘ইয়ুথ পজিশন’ চূড়ান্ত করেন।

মূল সম্মেলনের আগে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে- বরগুনা, হাওর এলাকার সুনামগঞ্জ, খরা ও বন্যাপ্রবণ লালমনিরহাট এবং পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-সম্পর্কিত ৩৫টি ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, ২৪টি ‘কী ইনফরম্যান্ট ইন্টারভিউ’ এবং চারটি ‘আঞ্চলিক ইয়ুথ কপ’ অনুষ্ঠিত হয়।
 

টিএইচ

News