
এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন ছিল একেবারে গণতন্ত্রের রান্নাঘর—যেখানে পঁচিশ টাকার ভাত-ডালের গন্ধে ভরে যেত দুপুর, আর তিনজন মিলে ভাগ করে খাওয়া এক প্লেট ভাতের মধ্যে বন্ধুত্বের স্বাদ মিশে থাকত। তখন ছেঁড়া জামা, ভিজে খাতা, আর হলের স্যাঁতসেঁতে দেয়াল ছিল ভবিষ্যতের মঞ্চ। রাতভর টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়া, দিনের বেলায় ক্যাম্পাসে তর্ক, আর ক্যান্টিনের গরম চা—এসবই ছিল জীবনের উচ্চতম বিলাসিতা।
আজ সেই ক্যান্টিনের ভাত বদলে গেছে ওয়েস্টিনের বুফেতে। যেখানে আগে ক্ষুধা মেটানো ছিল প্রয়োজন, এখন তা শুধু প্রপস—ইনস্টাগ্রামের ছবির জন্য। আগে ক্ষুধা ছিল পেটে, এখন ক্ষুধা চোখে—অন্যকে দেখানোর ক্ষুধা। যে হাত একসময় গ্লাসে রং চা ধরে ক্যাম্পাস রাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা করত, সেই হাত এখন কফি কাপ ধরে ফাইভ স্টারের লবিতে দাঁড়ায়।
শিক্ষার আসনও বদলে গেছে। আগে এখানে গবেষণা ছিল নীরব বিপ্লব, আজ তা নীরব মৃতদেহের মতো পড়ে আছে। হলের দেয়ালগুলোতে আগে লেখা থাকত স্বপ্ন, এখন শুধু লেগে আছে পোস্টারের আঠা। শিক্ষার্থীরা তখন নিজের খাতায় নোট নিত, এখন ফোনে ছবি তোলে; তখন পরীক্ষার হলে ঘাম ঝরত প্রশ্নের উত্তরে, এখন ঝরে সেলফির ফ্ল্যাশে।
এক সময় রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য, আজ রাজনীতি মানুষের ওপরে। তখন নেতারা দাঁড়াতেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে, এখন তারা দাঁড়ান বিদেশি হোটেলের কার্পেটের ওপর। আগে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হত মাটিতে বসে, এখন হয় ঝাড়বাতির নিচে। আগে ক্যান্টিনের ভাত ভাগাভাগি হত পাঁচজনের মধ্যে, এখন বুফেতে একজনের প্লেটে ওঠে পাঁচ রকম মাংস—অর্ধেকই অপচয়।
আমার শ্মশান বাংলা—এটি নিছক মৃত্যুস্থান নয়, বরং আমাদের বর্তমানের আয়না। শ্মশান জানে, শেষ গন্তব্যে সবাই সমান। কিন্তু জীবিত অবস্থায় আমরা মরিয়া হয়ে অসমান হতে চাই। শ্মশান নির্লিপ্ত, কারণ সে বোঝে বিলাসিতা শেষ অবধি ধুলো হয়ে যাবে। অথচ আমরা ধুলো মুছতে মুছতে ভুলে যাই—আমাদের শিকড় কতটা মাটির ভেতর।
বিলাসিতার আগেও ছিল জীবন, ছিল সংগ্রাম, ছিল স্বপ্ন। ফ্ল্যাট ছিল না, গাড়ি ছিল না, কিন্তু মানুষের চোখে আলো ছিল। এখন সেই আলো ম্লান হয়ে গেছে সোনালি ঝাড়বাতির নিচে। আজ যারা ফাইভ স্টারে হাঁস তুলে খায়, তারা একসময় ক্যান্টিনে মুরগির ঝোলের ভেতর আলুর টুকরো খুঁজত—কিন্তু মনে রাখার মতো বিনয় আর লজ্জা আজ আর নেই।
আমরা শিখেছি বিলাসিতাকে সাফল্যের প্রমাণ বানাতে। আগে ডিগ্রি ছিল গর্বের, এখন কেবল একটি ডেকোরেশন পিস—যা চাকরির বদলে দেয় সামাজিক পরিচয়ের ট্যাগ। আগে শিক্ষিত মানুষ মানে ছিল আলো, এখন তা কেবল দামি পোশাক আর বিদেশি উচ্চারণের প্রদর্শনী। আগে নীরবতা ছিল ধ্যানের, এখন তা উদাসীনতার।
গ্রামের মানুষ একসময় শহরে আসত শিক্ষার খোঁজে, শহরের মানুষ যেত গ্রামে উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে। এখন গ্রামও শহরের নকল, আর শহর কেবল বিদেশি বাজারের প্রতিচ্ছবি। আগের দিনে বিদেশি পাসপোর্ট ছিল পরিশ্রমের পুরস্কার, এখন তা সামাজিক প্রতিযোগিতার মেডেল।
শ্মশান এই উদাসীনতা বোঝে, কারণ সে জানে—সব শেষ হয়ে যাবে। যে হাতে সোনার চামচ, যে হাতে প্লাস্টিক, শেষ পর্যন্ত দুটোই পড়ে থাকবে একই মাটিতে। তবু আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে ভাবি—বিলাসিতা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। অথচ সত্য হলো, বিলাসিতা কেবল স্মৃতি মুছে দেয়, বাস্তবতার ধুলো ঢেকে দেয় রঙিন কাপড়ে।
আমার শ্মশান বাংলা ভালো নেই, কারণ সে দেখছে—আমরা শিকড় ভুলে যাচ্ছি। আমরা ভুলে গেছি যে, আমাদের এই অর্জনের মাটিতে আছে স্যাঁতসেঁতে হলঘর, ক্ষুধার্ত দুপুর, আর সস্তা খাতায় লেখা স্বপ্নের গল্প। আজ আমরা সেই গল্প মুছে দিয়ে লিখছি কেবল বিলাসিতার আত্মজীবনী।
তবু আমি শ্মশান বাংলাকে ভালোবাসি—কারণ অন্তত সে মিথ্যা বলে না। সে সাজে না, ভান করে না। তার চারপাশে নেই ঝাড়বাতি, নেই কৃত্রিম সুগন্ধি—আছে কেবল মাটির গন্ধ। আর সেই গন্ধই আমাকে মনে করিয়ে দেয়, মানুষের শেষ পরিচয় হলো মাটি, বিলাসিতা নয়।
যদি একদিন আমরা বুঝতে পারি, প্রগতির মানে সোনালি কার্পেট নয়, বরং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা—তাহলে হয়তো ক্যান্টিনের ভাত আবার ফিরে আসবে মানুষের জীবনে। তখন হয়তো ফাইভ স্টারের বুফে আর ক্যান্টিনের ডাল-ভাতের মধ্যে থাকবে না অহংকারের দেয়াল। তখন শিক্ষা হবে আলোর, রাজনীতি হবে মানুষের, আর বিলাসিতা হবে কেবল একটি বিকল্প।
আমার শ্মশান বাংলা ভালো নেই, কিন্তু সে অন্তত আমাকে সত্য শেখায়—অসম্পূর্ণতার মধ্যেও ভালোবাসা সম্ভব, কষ্টের মধ্যেও আলো সম্ভব, আর বিলাসিতার ভিড়েও বিনয়ের জায়গা রাখা সম্ভব। যতদিন এই সত্য থাকবে, ততদিন আমি তাকে ভালোবাসব—তার ধুলো, তার নীরবতা, তার শিকড়-সবই।
টিএইচ