
ছবি: আবু সালেহ মো. ইউসুফ
শহর যখন বাঁচার চেয়ে মৃত্যুর শঙ্কা জাগায়, তখন বোঝা যায় উন্নয়ন কেবল কংক্রিটে গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে সচেতনতা, দায়বোধ এবং পরিকল্পনার ভিতের ওপর। রাজধানী ঢাকার মিরপুরের রূপনগর শিয়ালবাড়ী মোড়ে ঘটে যাওয়া এক কিশোরের প্রাণহানি আমাদের আবারও সেই পুরোনো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে-কেন আমরা প্রতিবার প্রাণ হারালে তবেই চোখ খুলে তাকাই সমস্যার দিকে!
হাবিবুল্লাহ একটি নাম নয়, একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি সমাজের আশা। একটি শিশু, যার ভবিষ্যৎ তার মাদরাসার পাঠে, তার পরিবারের ভালবাসায় এবং তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার মাঝে নিহিত ছিল। অথচ সে আজ আর নেই-কারণ সে এমন এক রাস্তায় চলছিল যেখানে পূর্বেই জানা ছিল, দুর্ঘটনার ঝুঁকি প্রবল। তবুও সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, নেয়া হয়নি কোনো সতর্কতা, কোনো নিরাপত্তা।
এই শহরের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি রাস্তা যেন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে আরেকটি দুঃসংবাদের জন্য। এমন কী হওয়া উচিত! রাষ্ট্র কী কেবল ঘটনার পর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তৈরি! সরকার কী কেবল শোকপ্রকাশের পরেই সক্রিয় হয়! আর কতবার মায়েরা তাদের সন্তান হারাবে, আর কতবার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে দাঁড়াতে হবে, কেবল একটি সেতুর দাবি নিয়ে!
যে সমাজ প্রতিক্রিয়াশীল, সে সমাজ কখনো নিরাপদ হতে পারে না। প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক মনোভাবের, প্রয়োজন ঝুঁকি মূল্যায়নের এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের। দুর্ঘটনা যেখানে বারবার ঘটছে, সেসব জায়গা চিহ্নিত করে আগে থেকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কেবল একটি ব্রিজ নির্মাণ নয়, মানুষের জীবনের মূল্য বোঝা, তা রক্ষা করার আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করাই উন্নয়নের প্রকৃত চিহ্ন।
শহর উন্নত হয় তখনই, যখন তার রাস্তাগুলোয় মানুষ নিশ্চিন্তে চলতে পারে। একটি শিশু যখন স্কুলে বা মাদরাসায় যেতে গিয়ে সড়কে প্রাণ হারায়, তখন সেই শহরের সব আলো ম্লান হয়ে যায়। হাবিবুল্লাহর মৃত্যু যেন আর একটি সংখ্যা হয়ে না থাকে, যেন এই ঘটনার পরও আমরা নতুন হাবিবুল্লাহদের নিরাপত্তায় উদাসীন না থাকি।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার-শুধু রূপনগর নয়, পুরো নগরজুড়ে। প্রয়োজন সেই মানসিকতার বদল, যেখানে মৃত্যুই একমাত্র শিক্ষা নয়, বরং সম্ভাব্য বিপদকেই প্রতিরোধ করার মতো দূরদৃষ্টি জন্ম নেয় প্রশাসনের কাজে, সুশীল সমাজের কণ্ঠে এবং জনগণের চেতনায়।
একটি ব্রিজ হয়তো হাবিবুল্লাহকে আর ফিরিয়ে আনবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের অনেক প্রাণ রক্ষা পাবে। সেটাই যদি আমরা শিখে নিতে পারি, তবেই এই ক্ষতি অন্তত আরেকটি পরিবারের জন্য পুনরাবৃত্ত হবে না। হাবিবুল্লাহর শোক যেন আমাদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, আমাদের শাসনব্যবস্থার বিবেককে স্পর্শ করে-এই হোক আমাদের ন্যূনতম মানবিক অর্জন।