
২০১৪ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে কয়েক বছরেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর কোরবানির জন্য আট লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪টি খামারে এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিভাগ থেকে আসবে চাহিদার ৭০ শতাংশ।
এসব বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে প্রস্তুত রয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪টি ও খুলনা বিভাগে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৭টি। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ আসবে শুধু রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। সব মিলিয়ে এবার দেশি পশুতেই কোরবানির অর্থনীতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, বাংলাদেশে গরু রপ্তানি ঠেকাতে ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পর বৈধ পথে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধের আগে ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ২৩ লাখ। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই চাহিদা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয় দেশীয় খামারিদের উদ্যোগে। তবে অবৈধভাবে দেশের তিন-চারটি করিডর দিয়ে গরু প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সেটিও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
চলতি ২০২৫ সালে কোরবানির জন্য আট লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪টি খামারে এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতেই রয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯টি, দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪টি এবং খুলনা বিভাগে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৭টি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা এই তিন বিভাগে মোট কোরবানির পশুর প্রায় ৭০ শতাংশ জোগান দেবে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ আসবে শুধু রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) প্রাথমিক হিসাবে দেশে এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশু বিক্রি হবে।
এর মধ্যে অনলাইনে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। কোরবানির সময় বিভিন্ন পশুর ৯০ থেকে এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মোট চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় কোরবানির ঈদে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি ছাড়াতে পারে এক লাখ কোটি টাকা।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সেতু ডেইরি ফার্মের সত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সেতু কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কয়েক মাস ধরে ১২টি গরু লালন-পালন করছেন। এর মধ্যে গত রোজার ঈদে ছয়টি গরু বেশ ভালো দামে বিক্রি করেন। আর এখন কোরবানির ঈদে বাকি ছয়টি গরু বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গরু লালন-পালনের পাশাপাশি তিনি এআই কর্মী হিসেবে প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০টি কৃত্রিম প্রজনন করান। তাঁর এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকায় গরু লালন-পালনে যথেষ্ট স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন স্থানীয় তরুণ ও নারীরা। ওই অঞ্চলে আনুমানিক আড়াই মণ ওজনের প্রতিটি গরু ৮০ থেকে ৯৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।
আরেকটু বড় আকারের আনুমানিক পাঁচ মণ ওজনের গরু বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৭০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকায়। মাঝারি আকারের গরুর দাম এখনো বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগামী কয়েক দিন পর হয়তো গরুর দাম আরেকটু সহনীয় হতে পারে। দেশের পশু লালন-পালন ও কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমের প্রতীকী চিত্র সাজ্জাদ হোসেন সেতু। তিনি বলেন, ‘দেশে কোরবানি ও রোজার ঈদে যত পশু লাগুক না কেন, তা দেশের খামারিরাই উৎপাদন করার সক্ষমতা রাখেন।
এর জন্য পশুখাদ্যের দাম কমানো ও পশু পালনের উদ্যোক্তাদের ঋণ ও অর্থায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পশুপালনে উন্নত জাতের অভাব দূর করতে ভালো মানের ব্রিড ও সিমেনের (বীজ) সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই মূহূর্তে দেশে শাহিওয়াল গরুর বীজের বেশ চাহিদা রয়েছে। অবাধে মাংস ও পশু আমদানি বন্ধ করতে হবে। পশুর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তোলা ও প্রজনন ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই দেশ পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘দেশীয় পশুতেই এবারের কোরবানি করা সম্ভব হবে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় খামারিরা। স্থানীয় পর্যায়ে পশু উৎপাদন বেড়েছে। যার কারণে পশু আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। অবৈধভাবে পশু অনুপ্রবেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশের কোরবানির পশু নিরাপদ রাখতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে। এই ছাড়া পশুর হাটে পশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।’
গত অর্থ বছরে প্রায় ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। এর মধ্যে (প্রজননক্ষম হওয়া) গাভি ও বকনাতে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে ৩৮ লাখ ৮১ হাজার। অন্যদিকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাছুর উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৬ লাখ ৯৬ হাজার। এই ছাড়া ব্রিডিং বুল থেকে সিমেন উৎপাদন করা হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার ডোজ।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘সরকারের ধারণা করা চাহিদার চেয়ে প্রকৃত চাহিদা বেশি হতে পারে। ইফেকটিভ চাহিদা বাড়াতে পশুর দাম আরো সহনীয় করতে হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক বছরের পুরান বীজ (সিমেন) দিয়ে পশু প্রজনন করানো হচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম আরো বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। কৃত্রিম প্রজননে এখনো মাঠ পর্যায়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সব প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে এআই কর্মীদের আরো প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. মো. বয়জার রহমান বলেন, ‘পশু লালন-পালনের স্বনির্ভরতার পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ, কৃত্রিম প্রজনন ও মানসম্পন্ন ব্রিডের সম্প্রসারণ, খামারিদের সহায়তা প্রদানে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা রয়েছে। দেশের মানুষের যে হারে মাংসের চাহিদা বাড়ছে, তাতে কৃত্রিম প্রজননকে আরো বেগবান করতে হবে। কিন্তু আমরা চাই দেশীয় পশুর জাত সংরক্ষণ করতে।
টিএইচ