
ফাইল ছবি
আজ ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এই দিনটি শুধু একটা ছুটির দিন নয়, বরং বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের জন্য রক্ত-ঘামে গড়ে ওঠা এক প্রতীক। বাংলাদেশেও এই দিবসটি নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পালিত হচ্ছে, ব্যানার-ফেস্টুন, র্যালি আর সেমিনারে উচ্চারিত হচ্ছে শ্রমিকদের অধিকারের কথা। কিন্তু রাস্তায়, কারখানায়, মাঠে, কিংবা নির্মাণসাইটে যারা কাজ করে, সেই প্রকৃত শ্রমিকদের জীবনে এই দিনের প্রভাব আসলে কতটা! তারা কী তাদের প্রাপ্য সম্মান, সুরক্ষা ও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন!
শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলেও বাস্তবে তারা নানা দিক থেকে অবহেলিত। দেশে শ্রম আইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অতিরিক্ত কাজের সঠিক পারিশ্রমিক না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা—এসব এখনো শ্রমজীবী মানুষের নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে বহু শ্রমিককে কোনো ওভারটাইম ছাড়াই অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়, কখনো বেতন ছাড়াই ছাঁটাই করা হয়। নির্মাণশ্রমিক, দিনমজুর, হকার, রিকশাচালক কিংবা গৃহকর্মীর মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা মানুষরা তো আইন ও সুরক্ষার আলোতেই পড়েন না।
নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরো জটিল। তারা একই কাজ করেও পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম মজুরি পান। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চনা—এসব চিত্র এখনো বাস্তব। শ্রমিক অধিকার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের মৌলিক মানবাধিকারও নিশ্চিত করা হয় না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অন্তত ২৭টি সনদে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু বাস্তবায়নের চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। আন্তর্জাতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শ্রমিক অধিকারের দিক থেকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১তম, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
শিশু শ্রমের চিত্রও আশঙ্কাজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১০ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। যদিও সরকার ২৮৪ কোটি টাকার শিশু শ্রম নিরসন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সেই উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। একইভাবে প্রবাসী শ্রমিকরা যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সচল, তারাও বিদেশে নানামুখী হয়রানি ও অধিকারবঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। নিয়োগসংক্রান্ত প্রতারণা, চুক্তিভঙ্গ, শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
করোনাভাইরাস মহামারির সময় শ্রমিকদের দুর্দশা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। অনেকে বিনা নোটিশে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকেই মাসের পর মাস বেতন পাননি। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতে কাজের চাপে সময় বেড়েছে, কিন্তু মজুরি তাতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের তথ্য বলছে, তখন অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধিও মানেনি, যার ফলে শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে মে দিবসের তাৎপর্য আর প্রতীকী গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। শুধু র্যালি, সভা কিংবা ব্যানার নয়—চাহিদা এখন বাস্তব পরিবর্তনের। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কাজের নিরাপদ পরিবেশ, নারী ও শিশু শ্রমিকদের বিশেষ সুরক্ষা, এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ ছাড়া শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে দলীয় রাজনীতির বাইরে এনে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, সরকার ও মালিকপক্ষকেও আন্তরিকভাবে শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। শ্রমিকের সম্মান কেবল মে দিবসে উচ্চারিত স্লোগানে সীমিত না রেখে যেন তার জীবনের প্রতিদিনে প্রতিফলিত হয়, সেটিই হওয়া উচিত আজকের দিনের মূল বার্তা।
ইউ